আমার প্রবাসী পিতা

0 723

আমাদের পরিবারে ভাই বোন মোট আমরা তিন জন,সবার বড় আমি। যখন এই চিঠি লিখি তখন অন্য দু’জন পৃথিবীর আকাশ তারা দেখে নাই। আব্বু থাকতেন বিদেশে। বছরে বা ছয় মাসে একবার আসতেন। তাই সত্য বল্লে বাবার আবেদন টা আমি তেমন ভাবে বুঝতাম না। বাবা মা’র ঝগড়া ঝাটি লাগলে আমার ডাক পড়তো। দু’জনই চাইতেন আমি উকিলের ভূমিকা পালন করি এবং তাদের মধ্যকার বিবাদ মিটাই। আমি অতি সুচারু রুপে এই দায়িত্ব পালন করতাম।তখন দু’জনই আমাকে জড়িয়ে ধরতেন। বলতেন আমি তাদের কলিজার টুকরা। সেই স্মৃতি এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। একদিন মা আমাকে ধমকের সুরে বললেন,তুই তোর আব্বুর কাছে চিঠি লিখিতে পারিস না? তার বন্ধুর ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চারা বাপের কাছে চিঠি লেখে সে শুনে শুনে মন খারাপ করে। আমি মুখ গোমরা করে থাকলাম।ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ছি অতশত বুঝি না তখন। বিকালে মা আমাকে খাতা কলম নিয়ে আসতে বললেন আর ও বললেন যেন নীল কালারের কলমটা আনি।আমি কাগজ কলম এনে আম্মুর হাতে দিলাম,দেখলাম তিনি কিছুক্ষণ আকাবুকি করলেন,আমি ভাবছিলাম নতুন কিছু হবে বোধহয়। কিছুক্ষণ পর তিনি কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,“নে লেখ। অনেক বার লিখবি। লিখে লিখে হাতের লিখা সুন্দর কর। সবচেয়ে সুন্দর যেটা হবে ওটা আমাকে দিবি। কাঁটাছিড়া করবি না,বানান যাতে ভুল না হয় সে খেয়াল রাখবি। ছোট ছোট করে লিখবে অক্ষর হবে গোটা গোটা। আবার ঘোড়ার ডিমের মতো বানিয়ে রাখিস না। আর খেয়াল রাখবি দাড়ি কমা যাতে,ভুল না হয়,ঠিকমতো মাত্রা দিবি। আমি যেভাবে লেখলাম সেভাবেই লিখবি। লেখার সময় এদিক ওদিক তাকাবি না। তাকালে হাতের লিখা খারাপ হয়। সবমন দিয়ে বুচ্ছিস? নে,এবার লেখ।”এই বলে তিনি চলে গেলেন যাবার আগে আমার কপালে চুমো একে গেলেন,বল্লেন আমারা লক্ষী আব্বিটা সুন্দর করে লেখ। আম্মি তোমার জন্য মুড়িগন্ড বানাইতেছি। উল্লেখ্য খাবারটি আমার প্রিয় ছিলো। আম্মু চলে যাবার পরে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এ যে মহাগুরু দায়িত্ব।আমি কাজে মন দিলাম এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সে দায়িত্ব পালন করতে লাগলাম।যতটুকু মনে পড়ে এই চিঠি সাতবার লিখছিলাম। চিঠি লেখার সময় বুঝলাম আমাকে দিয়ে আব্বুর মান/রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা চলতেছে।আমি নিরবে হাসলাম।এখন কথা হইতেছে চিঠিটি আমার লিখা না আম্মুর লিখা হবে সেটা বুঝতে পারতেছি না।

আমি লিখলাম,দেখুন তো কেমন ছিলো সেটা?

“আদরের আব্বি,
তুমি কেমন আছ?? আমি ভালো। তোমার পায়ের ব্যথা ভাল হইছে?ওষুধপত্র ঠিকমতো খাও? নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করবা। রাত্রে বেশি জাগবা না। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বা।আমি ঠিকভাবে পড়ালেখা করি। আম্মুর কথা মন দিয়ে শুনি। তার কথা মতো চলি। খালি পায়ে ফ্লোরে হাটি না। গাড়ি দেখে রাস্তা পার হই। প্রতিদিন বিকালে মাঠে খেলতে যাই। কারো সাথে মারামারি করি না। পুকুর পাড়ে উকি দেই না। একা একা ছাদে যাই না। ক্লাসে আমার রোল এক। পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নাম্বার পাইছি,হৃদয় আমার সাথে পারে না। ওর হইছে তিন। আমার গত তিন দিন জ্বর ছিলো,এখন আমি ভালো। তুমি কবে আসবা? আসার সময় আমার জন্য কিসমিস আনবা। দাদা দাদী সবাই ভালো আছে। আম্মু ও ভাল আছে। তুমি আম্মুকে ফোন করো না কেন? সে তোমার জন্য কান্নাকাটি করে। অল্প অল্প কাজ করবা,আমাদের এত টাকা পয়সার দরকার নাই। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিবা। আমি শুক্রবারে মসজিদে নামাজ পড়তে যাই,তোমার জন্য দোয়া করি। চিন্তা করো না,আল্লাহ তোমার অসুখ ভাল করে দিবেন। তুমি বাড়িতে আসলে দেখবা আমি কত,বড় হইছি এখন আর তোমার জন্য কান্নাকাটি করি না। ও আরেকটা কথা আম্মি বলছে,সামনে বর্ষা,ঘরে ছাতা নাই। আসার সময় ছাতা নিয়ে আসবা,আমরটা হবে সবুজ। আব্বি তুমি অনেক ভাল,তাড়াতাড়ি চিঠির উত্তর দিবা। আম্মু আমাকে বকতেছে তোমাকে সালাম দিতে ভুলে গেছি তাই,সরি।আসসালামুআলাইকুম আমার প্রিয় আব্বি। ভালো থেকো। কয়দিন পর আবার চিঠি লিখবো তোমাকে।

                                                                                                                                                                                                      ইতি তোমার নাদিম।”

নোট: আব্বু তুমি খালি চোখে দেখ না? তোমার চশমা লাগে? তুমি চশমা পড়ে যে ছবি তুলছিলা ওইটা আমি দেখছি। বাড়ির সবাই ওই ছবি দেখে অনেক হাসছে। তোমারে নাকি বুড়া বুড়া লাগে। এটা আমার কথা না আম্মির কথা। তুমি তাকে ফোন করো। না হলে সে কষ্ট পাবে। এখন আর না পরে আবার কথা হবে। বাই বাই তা তা…ময়ূরপঙ্খী উড়ে এএএএএ যাহ……

Leave A Reply

Your email address will not be published.