সিঙ্গারার কাছে নিবেদন
কাছের মানুষ, বন্ধু ও পরম-আত্মীয়গণ।
আজকের এই বিক্ষুব্ধ করুণ সময়ে,
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিচ্ছেদের মিছিল ও ইউরোপ যুদ্ধের মহড়ায়,
আমি আমার শেষ প্রেমপত্রটি উন্মোচন করার সংকল্পবোধ করছি।
এটি কোনো প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লেখা নয়, এমনকি মাকেও নয়।
লিখছি না প্রিয় বন্ধু কিংবা ভাইয়ের কাছে।
আমি আমার প্রেমের শেষবাক্যগুলো নিবেদন করব,
হালকা আঁচে ভাজা, নরম-মচমচে,
বাদামি বর্ণের ও অতুলনীয় স্বাদের একটি সুলভ সিঙ্গাড়ার জন্য।
যাকে আপনারা পাবেন,
এই শহরেরই অলিতে-গলিতে, অফিসের নিচে, ফুটপাতে।
সংগ্রামী সারথিগণ,
মনে করে দেখুন সে দিনের কথাটি।
যখন আপনি ছিলেন ছোট্ট শিশু,
ছুটির দিনে বাবার আনা গরম সিঙ্গাড়ার আঁচ লেগে-
আপনার রক্তজবা ঠোঁট ফুলে যেত!
ভেবে দেখুন, অতীতের সোনালী সে সময়ের কথা,
ক্যাম্পাসে বন্ধুদের আড্ডায় ও দেশ উদ্ধারের আলোচনায়
সিঙ্গাড়া হাতে নিয়ে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা!
আমি আপনাকে আরো মনে করিয়ে দিতে চাই,
যখন আপনি দিনমজুর ছিলেন।
নীলক্ষেত, পলাশী, পুরান ঢাকার বকশী বাজারে ঘামে ভিজে রিকশা চালাতেন;
এবং বিশ্বাস করতেন-
সমাজতন্ত্রেই একদিন মুক্তি আসবে।
মনে করে দেখুন সেসব দিনের কথা!
আপনি ছিলেন সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে রাতদিন বিসিএস পড়ুয়া-
এক অযোগ্য বেকার প্রেমিক;
ইন্টারভিউ শেষে গলায় টাই ঝুলিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতেন সস্তা সিঙ্গাড়ার দোকান।
মাসের শেষে, সে সব চেপে রাখা কষ্টের দিনে-
মানিব্যাগের অবশিষ্ট ৫০ টাকা থেকে ১০ টাকার বিনিময়ে, কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে বরণ করেছিলেন আপনি।
দুটা সিঙ্গাড়া আর এক গ্লাস পানি।
সে ঘোরলাগা অত্যাশ্চর্য চমৎকার সময়ের কথা কী করে ভুলে যাবেন আপনি?
আমি ভুলিনি!
আজ সফল ব্যবসায়ী- যারা গুলশান-বনানীতে পাজেরো হাঁকিয়ে বেড়ান,
যেসব সরকারি আমলারা- কলমের খোঁচায় হাজার হাজার কোটি টাকার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিচ্ছেন-
আপনারা-আমরা সবাই পাঁচ টাকার সুলভ সিঙ্গাড়াটির কাছে এখনো বড্ড ঋণী!
তাই বলছি,
আপনি হয়তো সেই পরিপাটি খাদ্য রসিকদের একজন, যে সিঙ্গাড়ায় বাদাম পছন্দ করেন না।
প্রয়োজন পড়ে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ-সসের।
আপনি হতে পারেন সেই নিন্দনীয়দের কেউ,
যে কি না, সিঙ্গাড়ায় করলার অনুপ্রবেশ যৌক্তিক বলে রায় দিয়েছিলেন,
বলেছিলেন তা হবে গরীব বাঙালির জন্য বেশ স্বাস্থস্যম্মত।
অথবা আপনি হতে পারেন বিটিভির কোনো তোষামোদি টকশো বুদ্ধিজীবী,
কলিজা সিঙ্গাড়া বিদেশি আগ্রাসন কি না, যে এ বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে
দেশি সংস্কৃতি রক্ষায় কোমর বেঁধে নেমেছিলেন।
মোটকথা, আপনার ব্যক্তি পরিচয় ও মতাদর্শ যাই হোক
এবং পরিপাকযন্ত্রের গঠন যেমনই থাকুক-
যত্রতত্র সিঙ্গাড়া দেখেই আপনার লোভ জেগেছে, লালা ঝরেছে।
আপনি সিঙ্গাড়া মুখে নিয়ে কখনো ‘থু’ বলে ফেলে দিতে পারেননি।
তাই প্রেম সমপর্ণের এই মহতী ক্ষণে,
আমি আরো ধন্যবাদ দিতে চাই-
কারওয়ান বাজার সহ সারাদেশের অজস্র সিঙ্গাড়া মেরামতকারীদের-
যারা অবিশ্রান্তভাবে আমাদের জীবনযুদ্ধের রসদ সরবরাহ করে গেছেন।
স্যালুট দিচ্ছি,
বদমেজাজী বস, গীবতকারী কলিগ, ব্যাংকের ঘুষখোর অফিসার, বিশ্বাসঘাতক প্রেমিক
ও
আমাদের অফিস স্টাফদের, যারা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সিঙ্গাড়া নিবেদন করেছিলেন।
সিঙ্গাড়ার আর্থ-সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক গুরুত্ব, কখনো বলে শেষ করা যাবে না।
নিরূপায় হয়ে বরং এখানেই থামছি।
কারণ আমাদের আবার সিঙ্গাড়া খাবার সময় হয়ে এসেছে।
প্রিয় সিঙ্গাড়া,
তোমাকে লেখা আমার শেষ প্রেমপত্রটি মাত্র দু’টি বাক্যে শেষ করছি,
“তুমি নিজের দাম বাড়িয়ে সরকার আর সাবান কোম্পানির মতো কখনো আমাদের আশাহত করো না।
মূল্যস্ফীতির কলঙ্ক যেন তোমাকে স্পর্শ না করে।”
=সমাপ্ত=