ইতিহাসের দশটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ!
মানব সভ্যতার সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি হিসেবে দুর্ভিক্ষকে বিবেচনা করা হয়। খাদ্য সংকটের ফলে দুর্ভিক্ষের ঘটনা ঘটে। দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্ট অথবা প্রাকৃতিক, দু কারণেই হতে পারে। ইতিহাসে সাধারণ মানুষ বহুবার যুদ্ধ, খাদ্য সংকট ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে দুর্ভিক্ষের বলি হয়েছে। তেমন কিছু মর্মান্তিক ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো,
গ্রেট ফেমেইন আয়ারল্যান্ড (Great Famine Ireland, 1845-1852)
(১৮৪৫ – ১৮৫২) ১.৫ মিলিয়ন মৃত্যুছ

আলু আইরিশদের জাতীয় খাদ্য। তৎকালীন সময়ে আয়ারল্যান্ডের ৩২% মানুষ সরাসরি আলু উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিলো। “লেট ব্লাইট” নামক রোগের মহামারিতে আলু উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দুর্ভিক্ষের শুরু হয়। দীর্ঘ ৬-৭ বছর এই অবস্থা বজায় ছিলো। এদিকে ব্রিটিশদের বাধার কারণে অন্য কোন দেশের সেবা বা সাহায্য আইরিশরা পায়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুর্ভিক্ষে আইরিশ জনসংখ্যা প্রায় ২৫ ভাগ কম যায়। দেশছাড়া হয় ২ মিলিয়ন লোক।
ভিয়েতনামের দুর্ভিক্ষ (vietnam famine, 1945)
(১৯৪৫) ২ মিলিয়ন মৃত্যু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় পযন্ত ভিয়েতনাম ফ্রান্স সরকারের উপনিবেশ ছিলো। জাপানি আক্রমণ, ভিনদেশীদের অস্ত্র নির্মাণ, শস্য লুট ও নানান দ্বিধা বিভক্তির বলি হয় অসহায় ভিয়েতনামীরা। এর সাথে অনাবৃষ্টি, খরা ও পরপর অতিবৃষ্টি থেকে বন্যায় দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত ঘটে। যা প্রায় দুই মিলিয়ন ভিয়েতনামির প্রাণ কেড়ে নেয়।
উত্তর কোরিয়ার দুর্ভিক্ষ (North korean famine 1994-1998)
(১৯৯৪–১৯৯৮) ৩ মিলিয়ন মৃত্যু
ছএক নায়কতন্ত্র, ভুল নেতৃত্ব, বর্হিবিশ্বের সাথে বিচ্ছিন্নতা, বড় ধরনের বন্যায় শস্য বিনষ্ট হওয়া ও গুদামজাত খাদ্য ধ্বংসের কারণে উত্তর কোরিয়ায় দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত ঘটে। রাষ্ট্রের এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কোরীয় নেতা কিম জং ইল সামারিক খাতের অগ্রাধিকার ও অর্থ বরাদ্ধ প্রাধান্য দিয়েছেন। এমনকি জনগণকে রক্ষায় দেশের বাইরে থেকে কোন খাদ্য আমদানিও করেননি। অপুষ্টি ও অনহারে প্রতি এক হাজারে ৯৩ জন শিশু ও ৪১ জন মায়ের মৃত্যু উত্তর কোরিয়ায় ঘটেছিলো বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
রাশিয়ান দুর্ভিক্ষ (Russian famine 1921)
(১৯২১–১৯২২) ৫ মিলিয়ন মৃত্যু
১৯২১ সালে রাশিয়ায় এই দুর্ভিক্ষের শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত বিপ্লব ও পরপর কয়েকটি গৃহযুদ্ধে এমনিতেই টালমাটাল ছিলো সোভিয়েত রাশিয়ার অর্থনীতি। এছাড়া বলশেভিকদের নতুন শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, কৃষকদের ফসল কেড়ে নেয়া, ভালো শস্য উৎপাদন না হওয়া ও কৃষকদের অনাগ্রহের কারণে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। প্রায় ৫ মিলিয়ন লোক মারা যায় এ দুর্ভিক্ষে।
পঞ্চাশের মন্বত্তর (Bengal Famine Of 1943)
(১৯৪৩) ৭ মিলিয়ন মৃত্যু

ছবি : সংগৃহীত
১৯৪৩ সালে (বাংলায় ১৩৫০) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবলে দুর্ভিক্ষের শিকার হয় এ অঞ্চলের মানুষ। সরকারি নির্দেশে খাদ্য মজুত করা হয়েছিলো। বার্মা জাপানিদের অধিকারে চলে যাওয়ায় খাদ্য আমাদানিও বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া সৈন্যদের খাদ্য সরবরাহ, সমারিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, সরকারের অদূর দৃষ্টি সিদ্ধান্ত ও মজুদদারদের কারণে এই দুর্ভিক্ষের ঘটনা ঘটে। মারা যায় ৭ মিলিয়ন মানুষ।
ছিয়াত্ত্বর এর মন্বত্তর (Bengal Famine Of 1770)
(১৭৭০) ১০ মিলিয়ন মৃত্যু
১৭৭০ সালের (বাংলা ১১৭৬) দুর্ভিক্ষ বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বৃষ্টির কারণে ফসলহানি, খাদ্য মজুদ, কোম্পানির অধিক কর আরোপ, কৃষকদের জোর করে নীল চাষ করানো, কোম্পানির অব্যস্থাপনা ও অবহেলার কারণে এত মানুষের মৃত্যু ঘটে।
সোভিয়েত শাসনামলে দুর্ভিক্ষ (Soviet famine of 1932–33)
(১৯৩২–১৯৩৩) ১০ মিলিয়ন মৃত্যু

ছবি : সংগৃহীত
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ পযন্ত এ দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে অনুমান করা যায়নি। রাষ্ট্রপ্রধান স্তালিনের শাসন আমলে সাধারণ কৃষকদের উপর অমানবিক নিপীড়ন চালানো হয়। শস্য লুট, ভূমি দখল ও জবরদস্তি করে কৃষকদের খাদ্য গুদাম ধ্বংস করা হয়। অনাহার ও হত্যাযজ্ঞে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয় সে সময়ে।
চল্লিশের দুর্ভিক্ষ (The Chalisa famine of 1783–84)
(১৭৮৩ – ১৭৮৪) ১১ মিলিয়ন মৃত্যু
১৭৮৩ সালে ঘটা এই দুর্ভিক্ষ (হিন্দু বর্ষপঞ্জী অনুসারে ১৮৪০) চল্লিশের দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিত। ভারতের উত্তর প্রদেশে অনাবৃষ্টি, খরা, শস্য মৃত্যু, খাবার ও পানির সংকট প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চীনের দুর্ভিক্ষ (Chinese famine 1907)
(১৯০৭) ২৫ মিলিয়ন মৃত্যু

ছবি : সংগৃহীত
অনাহারে অল্প সময়ে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা এটি। কম শস্য উৎপাদন হয়েছিলো সেই সাথে বন্যা। ভয়াবহ বন্যায় চীনের বিস্তৃত অঞ্চল তলিয়ে যায়। কোন কোন অঞ্চলের সব ফসলই ধ্বংস হয়ে যায়। খাদ্য নিয়ে মারাত্বক দাঙ্গা, হাঙ্গামা দেখা দিত। প্রতিদিন অন্ত:ত ৫ হাজার করে মানুষ মারা যেত সে সময়।
চীনের মহা দুর্ভিক্ষ (The Great Chinese famine, ১৯৫৮–১৯৬১)
(১৯৩২–১৯৩৩) ৪৩ মিলিয়ন মৃত্যু
চীনের মহা দুর্ভিক্ষ। ছবি: সংগৃহীত
সোভিয়েত শাসকদের মতো চীনের মহা দুর্ভিক্ষের জন্য ও দায়ী করা হয়ে থাকে কম্যুউনিস্ট শাসকদের। ১৯৫৮ সালে চীনে ব্যক্তিগত ভূমি মালিকানা নিষিদ্ধ করা হয়। কৃষি ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা বদলে হঠাৎ করেই লোহা ও স্টিল উৎপাদনে উৎসাহিত করা হয়। জোর করে শ্রমিকদের ফ্যাক্টরিতে কাজ করানো হতো। এছাড়া কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এমন কিছু নতুন রীতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করা হয়েছিলো যা মোটেও কাজে আসেনি বরং ফসল উৎপাদন হার কমে যায়। ১৯৫৯ সালে বন্যা ও ১৯৬০ সালে তীব্র খরায় চীনে ভয়াবহ খাদ্য বিপযয় নেমে আসে। “দ্যা গ্রেট লিফ ফরোয়ার্ড” (১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য চীনের কমুউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ক্যাম্পেইন) শেষ হবার প্রাক্কালে ১৯৬২ সাল পযন্ত দুর্ভিক্ষে ৪৩ মিলিয়ন চাইনিজের মৃত্যু ঘটে।
তথ্যসূত্র: লিস্টভার্স ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে।