ইতিহাসের ধ্বংসাত্মক ১০ টি যুদ্ধ
অ্যাডলফ হিটলার বলতেন, যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই সর্বজনীন। ইতিহাসের এমন কোন অধ্যায় নেই যেখানে রণ ক্ষেত্রের ডামাডোল বাঁজেনি। পৃথিবীর শুরু থেকেই মানুষ সমর সংগ্রামে জড়িয়েছে। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের বলি হয়ে মরেছে বহু। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনায় দশটি যুদ্ধের বর্ণনা দেয়া হলো:-
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (World War II)
১৯৩৯ খ্রি. – ১৯৪৫ খ্রি.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বিবেচনা করা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে। হলোকাস্ট, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির কারণে আনুমানিক ৭ কোটি লোক এ যুদ্ধে প্রাণ হারায়। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়। দুইটি বৃহৎ সামরিক জোট অক্ষশক্তি (জার্মানী, ইতালি, জাপান) ও মিত্রশক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য) ১০ কোটি সামরিক সদস্য সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খল নায়ক হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক সমরাস্ত্রের ব্যবহার ও পৃথিবীর বেশিরভাগই রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ এত বেশি ক্ষয়ক্ষতির কারণ।
২. মঙ্গোল বিজয়াভিযান (Mongol conquests)
১২০৭ খ্রি. – ১৪৭২ খ্রি.
শিল্পীর কল্পনায় মঙ্গোল যুদ্ধ। ছবি : সংগৃহীতইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধগুলো পরিচালনা করেছে মঙ্গোলরা। প্রবল প্রতাপশালী মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল পৃথিবীর মোট ভূখন্ডের ২২ ভাগ। ইউরোপ, এশিয়া, সাইবেরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সহ ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ ও অবিচ্ছিন্ন ভূমির মালিক ছিলো তারা। চেঙ্গিস খান ছিলেন সাম্রাজ্যের প্রধান কান্ডারি। মঙ্গোলরা ৬ কোটির ও বেশি মানুষকে হত্যা করে। যা ছিলো পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ১১ ভাগ।
৩. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (World War I)
১৯১৪ খ্রি. – ১৯১৮ খ্রি.

আপা:ত দৃষ্টিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা গ্রেট ওয়্যার শুরু হয় অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্দিনান্দের (Archduke Franz Ferdinand) গুপ্তহত্যার মধ্য দিয়ে। তবে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ সংগঠিত হবার পিছনে এর চেয়ে বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ জড়িত। শক্তিশালী দেশগুলোর জন্য এটাই ছিলো প্রথম সম্মিলিত শো ডাউন বা শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ। চার বছর ব্যাপী এই যুদ্ধে, পৃথিবীর ৩ ভাগ মানুষের (৬ কোটি) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মৃত্যু ঘটে। অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, জার্মানি, বুলগেরিয়ার বিপরীতে যুদ্ধে সামিল হয়েছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও আমেরিকার মতো মিত্রশক্তিরা। এ যুদ্ধের ফল স্বরুপ পৃথিবীতে চারটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ও অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
৪. লুসান বিদ্রোহ (An Lushan Rebellion)
৭৫৫ খ্রি. – ৭৬৩ খ্রি.শ
চীনের তাং ও ইয়ান রাজবংশের মধ্যে বিবাদে সে সময়কালের হিসেবে পৃথিবীর ১৪ ভাগ মানষের মৃত্যু হয়। যা সংখ্যার হিসেবে ৩ কোটি ষাট লক্ষ। ইতিহাসের নৃশংসতম এ যুদ্ধে বহু নিরপরাধ প্রজা প্রাণ হারায়। ধারণা করা হয় দক্ষিণ চীনে ইয়ান রাজবংশের কোন এক জেনারেলের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিলো।
৫. তাইপিং বিদ্রোহ (Taiping Rebellion)
১৮৫০ খ্রি. – ১৮৬৪ খ্রি.
শিল্পীর চোখে কল্পিত তাইপিং বিদ্রোহ। ছবি: সংগৃহীত।
তাইপিং বিদ্রোহ ছিলো উনিশ শতকের প্রথম গণ-অভ্যুত্থান। চীনের জিং সাম্রাজ্যের অন্যায় অবিচার ও বহুকাল ধরে চলে আসা জুলুমের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। যা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলন ও গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। আনুমানিক ৩ কোটি মানুষ মারা যায় এ বিদ্রোহের ফলে।
৬. চীনের কুইং রাজবংশের উত্থান ও মিঙ্গদের পতন (Qing conquest of the Ming)
১৬১৬ খ্রি. – ১৬৬২ খ্রি.
মধ্যযুগে মিঙ্গ রাজবংশের শাসন, শোষণ ও কুইং উত্থানে চীনে ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এটি ছিলো তৎকালীন সময়ে মোট জনসংখ্যার ৪.৫ ভাগ। কুইং রাজবংশ, মাঞ্চু রাজবংশ নামেও পরিচিত ছিল। এটি ছিলো চীনের শেষ রাজবংশ।
৭. তৈমুরের বিজয় রথ (Tughlugh Timur conquest)
১৩৬৯ খ্রি. – ১৪০৫ খ্রি.

তৈমুর লঙ বিখ্যাত মঙ্গোলিয়ান যুদ্ধ বিজেতা ও সমর যোদ্ধা। মঙ্গল সাম্রাজ্যের পুন:প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতির জন্য তিনি নিষ্ঠুরতম পদক্ষেপ নিতেও পিছপা হতেন না। তৈমুরের কঠোর নেতৃত্বে মঙ্গোলিয়ানরা মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য, ভারত ও রাশিয়ার বিস্তৃত সব এলাকা দখল করে নেয়। এসব অঞ্চল জয় করতে গিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ও লুন্ঠন চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তার সেনাবাহিনীকে। তৈমুরের নৃশংসতায় আনুমানিক ২ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে। বিশ্বের বিভিন্ন সব দেশের মূল্যবান স্থাপত্য ও শিল্প ধ্বংসের জন্য তৈমুরকে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে।
৮. দুঙ্গান বিদ্রোহ (Dungan Revolt)
১৮৬২ খ্রি. – ১৮৭৭ খ্রি.
ওয়েই নদীর তীরবর্তী এলাকায় চীনে দুঙ্গান জাতি বিদ্রোহ করেছিলো কুইঙ্গ রাজবংশের বিরুদ্ধে। ধারণা করা হয় ১ কোটি বিশ লক্ষ লোক মারা যায় এ বিদ্রোহে। আন্দোলন ব্যর্থ হলে অভ্যুত্থানকারীরা রাশিয়া, কাজাখাস্তান ও কিরগিজিস্তান সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়।
৯. রাশিয়ান গৃহযুদ্ধ (Russian Civil war)
১৯১৭ খ্রি. – ১৯২১খ্রি.

সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বলশেভিক পার্টি ও সে সময়ের সর্ববৃহৎ রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অধিপতি জার (tsar) এর মধ্যে চলমান এই গৃহ যুদ্ধে আনুমানিক ৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। শাসকদের দীর্ঘদিনের অত্যাচার ও জুলুম ছিল এই বিদ্রোহ ও গৃহ যুদ্ধের মূল কারণ। রেড আর্মি বা সোভিয়েত বাহিনী সর্বপ্রথম প্রেট্রোগ্রাদ দখল করে নেয় এবং পরবর্তীতে পুরো রাশিয়া নিজেদের করায়ত্ত করে। পরবর্তীতে রাশিয়ান বিপ্লব বা সমাজান্ত্রিক বিপ্লব সমগ্র পৃথিবীকে নতুন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
১০. দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ (Second Congo War)
১৯৯৮ খ্রি. – ২০০৩ খ্রি.
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে ছয় বছর ব্যাপী এই যুদ্ধ আনুমানিক ৫৪ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। আফ্রিকান জাতিসমূহের মধ্যে ২৫ টি সশস্ত্র ও সামরিক বাহিনী সশস্ত্র এ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করা বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হয় রোগ ও অনাহারে। গৃহহীন লক্ষ লক্ষ লোককে আশ্রয় নিতে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ সমূহে।
তথ্যসূত্র: এক্সপ্লরেডিয়া অবলম্বনে