বিশ্বের বিভীষিকাময় কিছু গণহত্যা
কোন জাতি, ধর্ম বা গোষ্ঠীর উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ কে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৪৮ সালে রাফায়েল লেমকিন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বপ্রথম জেনোসাইড সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেন। বর্তমানে যেকোন পরিস্থিতিতে জেনোসাইড বা গণহত্যাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়। অতীতে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া কিছু নির্মম গণহত্যার ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো।
আমেরিকান আদিবাসী হত্যাকান্ড (Native American Genocide 1492 – 1969)

ক্রিস্টোফার কলম্বাস তথা ইউরোপিয়ানরা যখন আমেরিকায় আসে তখন থেকেই আমেরিকান আদিবাসীদের হত্যা করা শুরু হয়। নতুন এই ভূখন্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাচুয ভোগে তাদের একমাত্র বাধা ছিলো নেটিভ আমেরিকানরা। ইউরোপিয়ানদের অত্যাচারে অনেক নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায় ধ্বংস হয় যায়। তাদের বয়ে আনা প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ও বিভিন্ন জীবাণু বাহিত রোগে অনেক নেটিভ আমেরিকানের মৃত্যু ঘটে এমন সন্দেহও করা হয়। ইউরোপিয় উপনিবেশ থেকে শুরু করে নেটিভ আমিরেকানদের নাগরিকত্ব পাওয়ার আগ পযন্ত (১৪৯২ – ১৯৬৯) আনুমানিক ৯০ ভাগ নেটিভ আমেরিকান অর্থ্যাৎ ৬০ মিলিয়ন লোককের মৃত্যু হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।
হলোকাস্ট (Second world war holocaust 1941 – 1945)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনযজ্ঞ বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জঘন্য গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জার্মানির একনায়ক নাৎসি হিটলার ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সময়কালে ৬০ লক্ষের মতো ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন। যা ছিলো ইহুদির মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ।
কম্বোডিয়ার গণহত্যা (Cambodian genocide 1975 – 1979)
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পযন্ত কুখ্যাত শাসক পল পট এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট খেমারুজ শাসনকালে কম্বোডিয়ায় এ গণহত্যা সংগঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হহুদি গণহত্যার সাথে এই গণহত্যার মিল পাওয়া যায়। কম্বোডিয়ার সংখ্যালঘু ভিয়েতনামি, থাই, চাম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্ম যাজকরা কমিউনিস্ট শাসকদের লক্ষ্যবস্তু ছিলো। এদের তারা আগাছা ভেবে ছেটে ফেলাটাই সঠিক মনে করতো। ৪ বছর ধরে চলমান এই গণহত্যায় কম্বোডিয়ার ২৫ ভাগ মানুষকে হত্যা করা হয়। যা সংখ্যার বিচারে ৩.৫ মিলিয়ন। পল পট স্টালিনের মতধারায় বিশ্বাসী ছিলেন।
বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা (1971 Bangladesh genocide)
ছবি : সংগৃহীত
২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের গণহত্যা শুরু হয়। নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামে আনুমানিক ৩ মিলিয়ন (ত্রিশ লক্ষ) বাঙ্গালিকে হত্যা করা হয়। দুই লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। রাজাকার, আল বদর, আল শামস এসব সংগঠন গণহত্যা ও বিভিন্ন মানবতা বিরোধী অপরাধে পাকিস্তানীদের সাহায্য করেছিলো। সম্প্রতি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে হত্যাকান্ডের অভিযোগে দায়ে বেশ কয়েক জন অপরাধীর সাজা হয়েছে।
আর্মেনিয় গণহত্যা Armenian Genocide (1915 – 1917)

১৯১৫ সালের দিকে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে আর্মেনিয়ায় গণহত্যা সংগঠিত হয়। আনুমানিক ১.৫ মিলিয়ন আর্মেনিয়কে সে সময় হত্যা করা হয়। যদিও তুরস্ক কখনোই এই গণহত্যার কথা স্বীকার করেনি।
রুয়ান্ডা জেনোসাইড (rwandan genocide, 1994)
ছআফ্রিকার ছোট্টদেশ রুয়ান্ডার নৃশংসতা দেখে ১৯৯৪ সালে পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো। হুতু আর তুতসি সম্প্রদায় একে অপরের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। হুতুরা ১ মিলিয়ন সংখ্যালঘু তুতসি কে হত্যা করে। যা ছিলো মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ।
দারফুর জেনোসাইড (Darfur Genocide 2003)

এ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা ছিলো দারফুর গণহত্যা। ২০০৩ সালে পশ্চিম সুদানে সরকার ও মিলিশিয়াদের (Janjaweed) সংঘাতে ৫ লক্ষাধিক সাধারণ লোককে হত্যা করা হয়। শিশুদের হত্যা, নারী ধর্ষণ, খাবার পানিতে বিষ মিশিয়ে দেয়া সব ধরনের অত্যাচার চালানো হয়। মিলিশিয়াদের ডাকা হতো “ঘোড়ার আরোহী শয়তান” নামে। এ সময় ২ লক্ষের উপর লোক গৃহহারা হয়। দারফুরে, কালো-আরব, ধনী-গরিব, উত্তর-দক্ষিণ সব ধরনের সংঘাত রয়েছে। বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন দারফুরে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে।
পিগমী গণহত্যা (pigmy Genocide 1994)
ছবি : সংগৃহীত
রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর অধিবাসী পিগমীরা ছিলো রুয়ান্ডা গণহত্যার অন্যতম শিকার। কঙ্গোর বন-জঙ্গল থেকে ধরে ধরে পিগমী সম্প্রদায়কে হত্যা করা হতো। নৃশংস কিছু মিলিশিয়া বিশ্বাস করতো বাতয়া (Batwa) পিগমীদেরে মধ্যে অতিপ্রাকৃত কোন ক্ষমতা রয়েছে। তাদেরকে ভক্ষণ করলে তারা শক্তিধর হতে পারবে। এ জন্য এটা ছিলো একটা খেলা। প্রায় ৭০ হাজার পিগমিকে সে সময়কালে হত্যা করা হয়।
বসনিয়া গণহত্যা (Bosnian Genocide 1992 – 1995)

১৯৯২ যুগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে যাবার পর সার্ব, ক্রোট ও বসনিকরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয় স্বাধীনতা ও নিজ ভূখন্ডের জন্য। মুসলিম বসনিকরা ছিলো এই সংঘাতের সবচেয়ে ভুক্তভোগী। তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পযন্ত বর্তমান বসনিয়া ও হার্জোগোভিনার অঞ্চলসমূহের এই যুদ্ধে ৮ হাজারের বেশি বসনিক মানুষ মারা যায়। সার্ব জেনারেল রাকতো মালডিক (Ratko Mladic) কে এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী করা হয়।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, লিস্টভার্স ও দ্য রিচেস্ট।