বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নান্দনিক স্বাধীনতা স্তম্ভ

0 823

প্রতিটি দেশ অথবা জাতির এমন কিছু সৃষ্টিশীল নির্মাণ থাকে। যা তাদের বীরত্ব গাঁথা ও গৌরব সবার সামনে তুলে ধরে। দেশে দেশে, নানা প্রান্তের এমন কিছু বিখ্যাত স্বাধীনতা প্রতিকৃতি’র বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হলো।

ফ্রিডম মনুমেন্ট, রিগা (লাটভিয়া)

প্রায় ১২ হাজার নদী বেষ্টিত অপার প্রাকৃতিক সৌন্দযের দেশ লাটভিয়া। ইউরোপের অন্যতম এই ধনী দেশটি ১৯১৮ সালে ১৮ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। রাষ্ট্রীয় ভাষা হলো লাটভিয়ান। রাজধানী রিগা লাটভিয়ার অন্যতম বৃহত্তম শহর। এখানেই অবস্থিত “রিগা ফ্রিডম মনুউমেন্ট” । লাটভিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে ১৯৩৫ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। ৪২.৭ মিটার উঁচু এই স্থাপনাটিতে ৫৬ জন ভাস্কর কাজ করেছেন। এটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে, রেড গ্রানাইড, টার্বেনটাইন, ফেরো কনক্রিট ও কপার। প্রধান স্থপতির নাম, কার্লোস জোলে। স্থাপনার একটি চরিত্রে নিজেকে অঙ্কিত করে এই ভাস্কর ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছেন। স্থাপত্যের বিভিন্ন অংশ জুড়ে লাটভিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

ভাস্কযের সবার উপরের নারীটিকে ডাকা হয়  “মিলডা” নামে। তাকে বিবেচনা করা হয় লাটভিয়ার স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। নারীটির হাতের তিনটি তারকা লাটভিয়ার স্বাধীনতাকালীন তিনটি গরুত্বপূর্ণ এলাকাকে চিহ্নিত করে। এগুলো হলো, ভিডজেমি, কুরজেমি, লাটগালে। পিতৃভূমি ও স্বাধীনতার জন্য সম্মান দেখাতে লাটভিয়ার জন সাধারণ সব সময় স্থাপনাটিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। দুজন প্রহরীরা প্রতি আধঘন্টা পর পর জায়গা পরিবর্তন করে শ্রদ্ধা জানানোর রীতি রয়েছে রিগা ফ্রিডম মুনউমেন্ট ভাস্কযের।

ইনডিপেনডেন্স মনুমেন্ট, কিয়েভ (ইউক্রেন)

নয়নাভিরাম ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। পৃথিবীর সাতটি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান রয়েছে এখানে। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পরিচয় অনেকের কাছেই আধ্যাত্মিক শহর হিসেবে। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে “টানেল অব লাভ” বিখ্যাত।

১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ইউক্রেন। দেশটির স্বাধীনতা স্তম্ভ ইনডিপেনডেন্স মনুমেন্ট কিয়েভের স্বাধীনতা চত্ত্বরে অবস্থিত। প্যারেড, কনসার্ট ও শহরের বিভিন্ন ধরনের উৎসবের জন্য স্বাধীনতা চত্বর বিখ্যাত। ইনডিপেনডেন্স মনুমেন্ট উচ্চতায় ৬১ মিটার। এটিই ইউক্রেনের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কয। সবার উঁচুতে নারীর মূর্তিটি হাতে গিয়াল্ডার রোজের একটি ডাল হাতে ধরে আছে। ইউক্রেনের একতা, রক্ষাকারী ও পারস্পরিক ইতিহাস, ঐতিহ্যের অবয়ব হয়ে আছে এই স্থাপনাটি।

অ্যাঞ্জেল অব ইনডিপেনডেন্স (মেক্সিকো)

স্পেন থেকে স্বাধীন হয় মেক্সিকো। দেশটির স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বীরদের উৎসর্গ করে “অ্যাঞ্জেল অব ইনডিপেনডেন্স” নামক ভাস্কযটি নির্মাণ করা হয়। ১১৫ ফুট উঁচু এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেছেন স্থপতি অ্যান্থিনিও রিভাস মার্কাডো। দীর্ঘ আট বছরের নির্মাণ শেষে ১৯১০ সালে এটি জনসাধরণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ন্যায়পরায়ণতা, আইন, শান্তি ও যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে এটিকে বিবেচনা করে থাকে মেক্সিকানরা। পঞ্চাশের দশেকে ভূমিকম্পে এটির কিছু ক্ষতি সাধন হলেও পরবর্তীতে তা ঠিক করা হয়।

ইনডিপেনডেন্স মনুমেন্ট, কাম্পালা (উগান্ডা)

উগান্ডা বৃটিশদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়েছিলো ১৮৯০ সালে। ১৯৬২ সালে উগান্ডার স্বাধীনতাকে সামনে রেখে এক বছর আগে সেখানকার বৃটিশ সরকার এই স্মৃতি স্থাপনাটি নির্মাণ করে দেয় তাদের। ৬ মিটার উঁচু ইনডিপেনডেন্স মুউমেন্টটির শিল্পী কেনিয়ানবংশোদ্ভূত গ্রেগরি মাগুবা (Gregory Magoba)। স্থাপনাটিতে একজন নারী তার সন্তানকে আকাশ ছুঁতে সাহায্য করছে। উপনিবেশিক শাসন ও শৃঙ্গলা থেকে মুক্তির পথে উগান্ডার স্বাধীনতাকে নির্দেশ করে এই স্মৃতিস্তম্ভ টি।

ইনডিপেনডেন্স মনুউমেন্ট, ইয়াঙ্গুন (মিয়ানমার)

বৃটেন থেকে বার্মা বা মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে। তাদের স্বাধীনতাকে সম্মান করে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। ইয়াঙ্গুনের মাহা বাহদোলা পার্কে ইনডিপেনডেন্স মনুউমেন্ট টি অবস্থিত। প্রায় ৪৬ মিটার লম্বা ভাস্কযটির স্থপতির নাম সিলথু ইউ টিন। কিছু বছর আগে স্থাপনাটির ডিজাইনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। উল্লেখ্য, ইনডিপেনডেন্স মনুউমেন্ট হবার আগে এখানে রানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি ছিলো। মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর, মূর্তিটি পুনরায় ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।

ইন্ডিয়া গেট, নয়াদিল্লি (ভারত)

নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইন্ডিয়া গেটকে, দিল্লি মেমোরিয়াল বা অল ইন্ডিয়া ওয়্যার মেমোরিয়ালও বলা হয়। ৪২ মিটার উঁচু এই সৌধটির স্থপতি ছিলেন স্যার এডিউন লুটিনস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত প্রায় নব্বই হাজার ভারতীয় ও বৃটিশ সৈন্যদের সম্মানার্থে ১৯২১ সালে এটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেষ হয় দশ বছর পর। উল্লেখ্য সে বছরই নয়াদিল্লিকে ভারতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইন্ডিয়া গেটের গায়ে নিহত সৈনিকদের নাম খোদাই করা আছে।

স্ট্যাচু অব লিবার্টি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)

যুক্তরাষ্ট্রের হাডসন নদীর তীরে অবস্থিত স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে ডাকা হয় “লেডি অব লিবার্টি” নামে। হাতে আলোকবর্তিকা ও বই হাতে ভাস্কযটি নির্মাণ করেন ফ্রেডরিক অগাস্টাস বার্থোলডি ও গুস্তাভ আইফেল। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৮৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার এটি উপহার দেয়। এটির উচ্চতা ৯৩ মিটার। বইটিতে রোমান অক্ষরে খোদাই করে লিখা আছে, জুলাই ৪, ১৭৭৬। এটি আমেরিকার স্বাধীনতা সাল। ১৯২৪ সালে আমেরিকা এটিকে জাতীয় ভাস্কয হিসেবে ঘোষণা করে।

আইফেল টাওয়ার, প্যারিস (ফ্রান্স)

প্রতি বছর পৃথিবীর যে স্থানটি সবচেয়ে মানুষ বেশি মানুষ (আনুমানিক ৪০ লক্ষ) ভ্রমণ করতে আসে সেটি হলো প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। ফরাসি বিপ্লবের শততম বার্ষিকী স্মরণ করে রাখার জন্য বিভিন্ন নকশা আহ্বান করা হয়। যাচাই বাছাইয়ের পর গুস্তাভ আইফেলের নকশাই বিচারকরা চূড়ান্ত বলে ঘোষণা দেন। ৩১২ মিটার উঁচু এই স্থাপনাটি নির্মাণ কাজ ১৮৮৭ সালে শুরু হয়ে ১৮৮৯ সালে শেষ হয়।

জাতীয় সৌধ, জাকার্তা (ইন্দোনেশিয়া)

১৩৭ মিটার উঁচু এই সৌধটি মারদেকা স্কয়ার, জাকার্তায় অবস্থিত। ডাচদের কাছ থেকে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রতি সম্মান জানিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়। সৌধটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৬১। স্থপতি হলেন, ফ্রেডরিখ সিলাবান। ১৯৭৫ সালে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।  এটি সহমর্মিতা, ভারসাম্য, উর্বরতা ও চিরন্তন জীবনবোধ তুলে ধরে।

স্বাধীনতা সৌধ, আসখাবাদ (তুর্কেমেনিস্তান)

তুর্কেমেনিস্তানের ঐতিহাসিক তাবুর আকৃতিতে আসখাবাদ স্বাধীনতা স্তম্ভ বানানো হয়। ২৭ মিটার আচ্ছাদন সহ ৯১ মিটার লম্বা এ টাওয়ারটিতে ছয়টি প্রদর্শনী হল রয়েছে। সেখানে তুর্কেমেনিস্তানের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রাম তুলে ধরা হয়ছে। দেশটি ২৭ অক্টোবর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

Leave A Reply

Your email address will not be published.