“গোল চশমা ও অনামিকা রিং”
গোল গোল চশমা পড়া মেয়ে দেখলে আমার বুকের ভিতর কিঞ্চিত ব্যথা অনুভূত হয়। এই রোগটা আকাশ থেকে আসে নাই। ঘটনা শুরু অনেক আগে থেকে। তখন আমি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে পড়তাম। আমার এক ক্লাসমেট ছিলো। ডাকনাম “তুবা”। তুবা’দের বাড়ি ছিলো আমাদের বাড়ির দু বাড়ি পরে। ওরা ভাড়া থাকতো। পরিবারে ওরা ছিলো বাবা মা সহ দুই ভাই বোন। আমার যতটুক মনে হয় তুবা’দের ফ্যামেলির সবার “চোখের সমস্যা” আছে। কারণ ওর বাবা,মা, বড় ভাই সবাই চশমা পড়তো। ওর চোখেও ফ্রেমে বাঁধা পড়ে সেই নার্সারি থেকে। তবে চশমাটা যেন ওর চেয়ে এক সাইজ বড়ই ছিলো। তাই প্রায় দেখতাম কথা বলতে বলতে ওর চোখের চশমা নেমে নাকে চলে এসেছে। কখনো মজা করে আমরা পরিচিতরা চশমাটা কখনো একটু উপরে তুলে দিতাম। কাজটা বারবার করলে ও ক্ষেপে যেত। আর ওর মুড ভালো থাকলে, একটা নকল হাসি দিয়ে বলতো, থ্যাংকস।
তুবা দেখতে ছিলো বেশ ফর্সা। চেহারার কাট’টা ছিলো গোলগাল ভরপুর। চুল ছিলো মাঝারি। গোল চশমায় ওকে এমন মানাতো যে চোখে বুঁজে দশে দশ দেয়া যাবে। ছোটবেলা থেকেই ও খুব চুপচাপ শান্ত শিষ্ট মেয়ে ছিলো। আর পড়ালেখায় সহজাত চশমা পড়া মেয়েরা যেমন হয়,বরাবরই ভালো। বিকেল মাঝে মাঝে আমারা খেলতাম। তবে দৌড় ঝাপ, গোল্লাছুট না। ও ওর পছন্দ মত ঘর কাটকাটি খেলবে, তিনের গুঁটি খেলবে। এসব খেলায়ও কোন চুরি চোরামির মধ্যে সে নাই। হারলেই যেন মনে হয় ও বেশি খুশি। চোখ বড় বড় করে বলতো, “বাপরে,তুই দেখি অনেক চালাক!” তবে এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা হলো, সরল সোজা মেয়েদের সাথে চিট করা অসুবিধাজনক। ওর সাথে ছক্কা খেলতে যতবার আমি চুরি করতাম আর ফল স্বরুপ বড় সাপটার মুখে পড়তাম। আমার মুখ কালো হয়ে গেলে ও বলতো, আচ্ছা যা আবার মার। আমি মারতাম আবারও সাপের মুখে পড়তাম। ও দ্বিতীয় সুযোগও দিতো। আমি পার পেতাম আর ওর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তবে এ কথা সত্য তা কখনো মুখে প্রকাশ করিনি।
আরও একটা মজার বিষয় ছিলো। ছোট খাট ভাব ভালোবাসাগুলো ওর কাছে প্রকাশ করার কোন সুযোগ ছিলো না আমার। কারণ সোজা, ওকে ছোট খাট খোঁচাখুঁচি কোন ছেলে দিলেও সে সব কথা সে বাবা মা’কে বলে দিত। ওর বাবা ছিলো থানার এসপি। আর ও বয়সে পুলিশের পোশাক দেখলেই আমাদের সবারই যে পোশাক নষ্ট হবার অবস্থা হতো তা তো কারো অস্বীকার করার উপায় নাই। তাই আমাদের সার্কেলের কেউ ভুলভাল করলে বা করার চেষ্টা করলে কানমলা বেদম ঠেঙ্গানি খাইছে আর আমি তা দেখে শিখছি। ভয়েও সামনে আগাই নাই।
তাই এমন মিষ্টি একটা মেয়ের প্রেমে তো পড়ছিলামই তবে সিরিয়াস ক্রাশ খাইছিলাম ক্লাস সেভেনে থাকতে এক ঈদের দিন। কাল রং এর একটা ড্রেস পড়ছিলো ও। নখে আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক,পায়ে হাই হিল লাল জুতা। দেখলে যেন মনে হবে না এই মেয়ে এই গ্রহের কেউ। অপরিচিত কেউ কথা বলতে গেলে নিশ্চিত হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যাবে। আর আমার নিজেকে যেন খুব অপরিচিতই মনে হচ্ছিলো। যেন এ মেয়েকে আমি চিনি না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সামনে গিয়ে কথাটা বলি,ওকে খুব সুন্দর লাগছে। সাহসে কুলায়নি।
এরপর ও অন্য একটা স্কুলে চলে গেছে। বাবা’র বদলি। ফোনে কথা হয়েছে আমাদের কয়েকবার। কিছুদিন পর তাও বন্ধ। কারণ দুজনেই বড় হচ্ছি,আমরা আমাদের আপণ পৃথিবী চিনছি,স্বার্থ চিনছি। আর সেই সাথে মোটের উপর আমরা দুজনেই যেহেতু “ভালো ও ভদ্র” আমাদের কাছকাছি যাবার সম্ভাবনা ততই কমছিলো।
আমাদের সর্বশেষ দেখা হলো এক বিয়ে বাড়িতে। এক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম,সেখানেও অপরিচিতের মতই ছিলাম। আমি বুঝলাম আমাদের সেই আগের মেয়েটি ও আর নেই। অনেক বড় হয়েছে। ভার্সিটিতে পড়ে। বেশ হাসিখুশি আর চঞ্চল হয়েছে ও। অনেক কথা বললাম আমরা। ছোটবেলার সব স্মৃতি আমার চেয়ে ওরই ভালো মনে আছে। কথা বলতে বলতে ঠিক অনেক্ষণ পর খেয়াল করে দেখলাম আজও পড়নে কালো ড্রেস। চোখে কাজল, নখে লাল নেলপলিশ। বাহ। ভেবে দেখলাম সবই ঠিক আছে। মাঝে দশটা বছর কেটে গেল শুধু। খুব সুন্দর লাগছিলো ওকে। আর ভয় পেলাম না। বলেই ফেললাম,তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। কারণ আজ সবকিছুর সাথে বাড়তি হিসাবে ওর অনামিকা’য় যে সোনলী একটা রিং ও আছে!