আলোচিত জিম্মি উদ্ধার ঘটনা
জিম্মির ঘটনা যতটা আকস্মিক ততটা অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা ও নিরপরাধ মানুষ অহরহ জিম্মির শিকার হচ্ছেন। ঘটনাবহুল কিছু জিম্মি উদ্ধার ঘটনার তালিকা নিচে দেওয়া হলো,
১. অপারেশন এন্তেবে (operation Entebbe)
৪ জুলাই, ১৯৭৬

অপারেশন এন্তেবের মিলিটারি নাম অপারেশন থান্ডারবোল্ট। ইতিহাসের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ও সফল জিম্মি উদ্ধার ঘটনা হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হয়। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্যা লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (Popular Front for the Liberation of Palestine) নামের একটি সংগঠন ২৪৮ জন যাত্রীসহ এয়ার ফ্রান্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করে। জিম্মিকারীদের ইচ্ছে ছিল শুধুমাত্র ইসরায়েলি নাগরকিদের আটকে রাখা্। তাই ১০৬ জন ইসরায়েলী নাগরিক ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়। বিমানটি নিয়ে যাওয়া হয় উগান্ডার এন্তেবে (Entebbe) বিমানবন্দরে। প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন হাইজাক্যারদের জিম্মিকারীদের সমর্থন করতেন। তাই পরিস্তিতি ঘোলাটে আকার ধারণ করে।
উপায়ন্তর না পেয়ে, প্রায় ১০০ ইসরায়েলি কমান্ডো ২৫’শ মাইল পাড়ি দিয়ে এন্তেবে বিমানবন্দরে আসে, অপারেশন পরিচালনা করার জন্য। এক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করা অভিযানটির ব্যপ্তি ছিল ৯০ মিনিট। সংঘর্ষে ৭ জন হাইজ্যাকার, ৩ জন জিন্মি ও ৪৫ জন উগান্ডার সৈন্য নিহত হয়। ইসরায়েলি কমান্ডাররা মিশনে তাদের ১ জন সৈন্যকে হারায়। তিনি ছিলেন, ইয়োনাটান নেতানিয়াহু (Yonatan Netanyahu)। ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর (Benjamin Netanyahu) ভাই।
২. অপারেশন চাভিন ডি হান্টার (Operation Chavín de Huántar)
এপ্রিল ২২, ১৯৯৭
জাপানিজ অ্যাম্বাসি হোস্টেজ ক্রাইসিস ভয়াবহ জিম্মি ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সম্রাট আকিহিতোর ৬৩ তম জন্মদিন উপলক্ষে পার্টির আয়োজন করা হয় পেরুর জাপানি অ্যাম্বাসেডরের বাসভবনে। পাঁচশ এর বেশি কূটনৈতিক, সামরিক ও সরকারি অফিসার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কঠোর নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও বাসভবনটি ঘেরাও করে “দ্যা টুপাক আমারু রেভুলেশনারী মুভমেন্ট (মার্তা )”। বাইরের ৫০ ও ভেতরের ১০ জন নিরাপত্তারক্ষীকে হত্যা করে ১৪ জন বিদ্রোহী ভিতরে প্রবেশ করে।
চার মাস ধরে আলোচনা চালিয়ে মাত্র ৭২ জন জিম্মিকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিলো।এদিকে পেরুর সামরিক বাহিনীর নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি শুরু করেছিলো। এ সময় তারা ঐ বাড়িটির রেপ্লিকা তৈরি করে ও বেশ কয়েকবার খসড়া প্রস্তুতি চালায়। অবশেষে, ২২ এপ্রিল অভিযান পরিচালনার জন্য চূড়ান্ত দিন হিসেবে ঠিক করা হয়। বাড়ির নিচে বেশ কয়েকটা টানেল খুঁড়ে অভিযান চালায় সৈন্যরা। যুদ্ধে ২ জন কমান্ডো, ১ জন জিম্মি ও ১৪ জন বিদ্রোহী নিহত হন। পেরুর একজন পুরাত্তাত্বিকের নাম অনুসারে এই অপারেশনটির নামকরণ করা হয়েছিলো।
৩. অপারেশন ফেউরেযাবুর (Feuerzauber)
১৮ অক্টোবর ১৯৯৭
চার জন প্যালেস্টাইন ও লেবানিজ সন্ত্রাসী জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে লুফথানসা ফ্লাইট ১৮১ জিম্মি করে। জিম্মিকারীরা বেশ কয়েকটি বিমানবন্দরে ব্যর্থ চেষ্টার পর সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে অবতরণ করে। তারা তাদের কমান্ডো মার্টায়ার হালিমা (Commando Martyr Halima) নামে পরিচয় দেয়। উল্লেখ্য, হালিমা অপারেশন এন্তেবের নিহত এক সৈনিকের নাম। আক্রান্ত পশ্চিম জার্মানী সরকার তাদের কমান্ডোদের বৃহৎ সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করে ফেলে। অভিযানে খুব খারাপ কিছু ঘটার আগেই সেনারা কৌশলে জিম্মিকারীদের বাধ্য করে বিমানের জরুরি বর্হিনির্গমন দরজা খুলে দিতে। অতর্কিত হামলায় তিনজন জিম্মিকারীকে হত্যা করা হয় এবং একজনকে আটক করা হয়।
৪. জেসিকা লিন্চের উদ্ধার অভিযান (JESSICA LYNCH)
২৩ মার্চ, ২০০৩
২০০৩ সালে নাসিরিয়ায় ইরাকি বাহিনী, ইউএস আর্মির জেসিকা লিন্চকে বন্দী করে। ইতোমধ্যে তার কোম্পানীর ১১ জন সৈন্য নিহত হয়েছিলো। বন্দীর ৯ দিন পর আমেরিকান সেনারা তাকে ইরাকী কারাগার থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আলোড়ন তোলা এই ঘটনাটি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কারাগার থেকে বন্দী মুক্তির সফল কোন উদ্ধরাভিযান। যদিও অনেকে ঘটনাটি পেন্টাগনের সাজানো বলে দাবি করেন।
৫. ক্যাবানাতুন আক্রমণ (Cabanatuan Attack)
জানুয়ারি ৩০, ১৯৪৫

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ফিলিপাইন দখল করে নেয়। হাজার হাজার ফিলিপিনো ও আমেরিকান সৈন্যদের জাপানি সেনারা বন্দী করে রাখে। কিছু বছর পর আমেরিকার সৈন্যরা যখন পুনরায় আক্রমণ শুরু করে, জাপানিরা তখন বন্দীদের নৃশংসভাবে হত্যা করতে থাকে।উ
প্রায় ৪’শ আমেরিকান সৈন্য জাপানি ক্যাম্প আক্রমণ করে এবং পাঁচশ প্রায় বন্দীকে উদ্ধার করে। যুদ্ধবন্দী উদ্ধারের ঘটনায় এটিকে অন্যতম বৃহৎ অপারেশন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৬. বেসলান স্কুল ধ্বংসযজ্ঞ (Beslan school siege)
১ সেপ্টেম্বর ২০০৪
২০০৪ সালে ইসলামিক উগ্রবাদীরা রাশিয়ার দক্ষিণ ওশেটিয়ার একটি স্কুলের ৭৭৭ জন ছেলেমেয়ে সহ ১১০০ জনকে বন্দী করে। তারা রাশিয়ার কাছ থেকে চেচনিয়ার বিচ্ছিন্নতা দাবি করে। ছাত্র শিক্ষক ও অভিভাবক সহ সবাইকে খাবার দাবার না দিয়ে একটি জিমনেশিয়ামে বন্দী করে রাখা হয়। ভিতরে অনেক গোলা বারুদ থাকায় অভিযান পরিচালনা করা সহজ ছিলো না। রাশিয়ার স্পেশাল ফোর্স বন্দী দশার তৃতীয় দিনে অভিযান শুরু করে। ট্যাঙ্ক, রকেট লাঞ্চার সহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার কর হয়। দু:খ জনকভাবে অভিযানে ৩৮৫ জন বন্দী মারা যেখানে ১৮৬ জন শিক্ষার্থী ছিলো। জিম্মিকারীদের একজন আটক হয় ও বাকিদের হত্যা করা হয়। চেচনিয়ার স্বাধনীতা আন্দোলনকামী রিয়াদাস সালিকিন (Riyadus-Salikhin) এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়।
৭. অপারেশন নিমরোধ (Operation Nimrod)
৫ মে, ১৯৮০

কিছু সশস্ত্র ইরানি বিচ্ছিন্নতাবাদী লন্ডনে সেদেশের অ্যাম্বাসীতে হামলা চালায়। তারা ২৬ জনকে গৃহবন্দী করে রাখে। বিনিময়ে জিম্মিকারীরা তাদের কিছু আরব বন্দীদের মুক্তি চায় ও যুক্তরাজ্য ত্যাগ করার নিরাপত্তা দাবি করে। আলোচনা চলাকালে ৫ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হলেও শর্ত পূরণ না হওয়ায় একজনকে হত্যা করে দেহ বাইরে ছুড়ে ফেলা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে ব্রিটেনের স্পেশাল এয়ার সার্ভিস (Special Air Service) অভিযানের দায়িত্ব নেয়। ৬ দিন পরে চালানো ঝটিকা অভিযানে জিম্মিকারীরা সবাই মারা যায়। একজন ছাড়া বাকিদের সুস্থভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। জিম্মি উদ্ধার তৎপরতায় এটিকে অন্যতম সফল অভিযান হিসাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। অভিযানে সফলতার পর এক জরিপের দেখা যায় বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিলো।
৮. অপারেশন জেরিকো নাৎসি (Operation Jericho Nazis)
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সে জার্মানদের দখল করা বন্দী শিবিরে ব্রিটিশ বিমান হামলার অপারেশন এটি। অভিযানে ৭১৭ জন বন্দীকে উদ্ধার করার জন্য নয়টি মোস্কিউটো বোম্বার বিমান (de Havilland Mosquito) হামলায় অংশগ্রহণ করে। তবে মাত্র ৭০ জন বন্দী মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হয়েছিলো। বাকিদের হত্যা করা হয়।
৯. মস্কো থিয়েটার জিম্মি (Moscow theatre hostage)
২৩ অক্টোবর, ২০০২

মস্কোর ডাবরবকা থিয়েটারে (Dubrovka theatre) ৪০ থেকে ৫০ জন সশস্ত্র চেচনিয় বিদ্রোহী হামলা চালায়। থিয়েটারের জটিল কাঠামোর জন্য অভিযান পরিচালনায় সৈন্যদের বেগ পেতে হয়। বিদ্রোহীদের নিস্ত্রীয় করতে গ্যাস ব্যবহার, পরবর্তীতে বিতর্কের সৃষ্টি করে। ৮৫০ জিম্মির মধ্যে ১৭০ জন প্রাণ হারায়। বাকিদের নিরাপদে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
১০. অপারেশন বারাস (operation barras)
সেপ্টেম্বর ১০, ২০০০
সিয়েরালিওনে নিরাপত্তা রক্ষায় নিযুক্ত ব্রিটেনের রয়েল আইরিশ রেজিমেন্টের (Royal irish regiment) ১৮ জন সদস্যকে জিম্মি করে ওয়েস্ট সাইড বয়েস (West Side Boys) নামের একটি সংগঠন। ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস (SAS) নৌ ও হেলিকাপ্টার যোগে বিশ মিনিটের এক ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে। এতে ২৫ জন বিদ্রোহী নিহত হন ও ১৮ জনকে বন্দী করা হয়। একজন বৃটিশ সৈন্যর মৃত্যু ঘটে।
তথ্যসূত্র: এক্সপ্লোরোপিডিয়া অবলম্বনে।