আগামী পৃথিবীর জন্ম হয় যে শহরে

0 713

পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে বসে আপনি যখন এই লেখাটি পড়ছেন। তখন কিছু স্বপ্নবাজ মানুষ দিন রাত পরিশ্রম করে আঁকছে ভবিষ্যতের মানচিত্র। সিলিকন ভ্যালি! যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া’তে অবস্থিত এই শহরটিকে সবাই চিনে তথ্য প্রযুক্তির রাজধানী হিসেবে। যেটি মূলত: সানফ্রান্সিকো বে এরিয়া নামে পরিচিত। ইন্টেল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, ইয়াহু, অ্যামজন এর মতো বড় বড় সব প্রযুক্তি কোম্পানির সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত। প্রযুক্তির এই বাণিজ্যে এলাকাটি বর্তমানে ৩০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

যেভাবে শুরু,

সিলিকন ভ্যালির সাথে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নাম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ডীন ফ্রেডরিক টারমেন তার শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের আশেপাশে কোথাও নিজেদের কোম্পানি খোলার জন্য উৎসাহ দিতেন। সে অনুপ্রেরণা থেকেই উইলিয়াম হিউলেট (William Hewlett), ডেভিড প্যকার্ড (David Packard) দুই শিক্ষার্থী প্রথম স্ট্যানফোর্ড শিক্ষার্থী হিসেবে ৫৩৮ ডলার বিনিয়োগ করে সিলিকন ভ্যালিতে। তার পরের বছর ১৯৩৯ সাল থেকেই বিখ্যাত Hp কোম্পানি তাদের ব্যবসা শুরু করে।

হিউলেট-প্যকার্ড কার গ্যারেজ। এই ঘরটিকে বলা হয় বার্থ প্লেস অব সিলিকন ভ্যালি।

সিলিকন ভ্যালির একেবারে শুরুর উদ্যেক্তা এ দুজন\

বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও ইনিঞ্জনিয়ারিং কোম্পানীর গবেষণা পরিচালনার জন্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সাহায্য করতো। ১৯৫১ সালে এখানে স্থাপিত হয় গবেষণা পার্ক। তথ্য প্রযুক্তির প্রসারে এটাই ছিলো প্রথম এমন কোন উদ্যোগ।

John Bardeen,  William Shockley, Walter Brattain ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯৫৬ সালে ট্রানজিস্টার নিয়ে কাজ করে তারা নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

তবে যদি এককভাবে কোন ব্যক্তিকে সিলিকন ভ্যালির নায়ক বলতে হয়, তাহলে ইংরেজি বংশোদ্ভত পদার্থবিদ উইলিয়াম শোকলে’র নাম চলে আসবে। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব থেকেই বিখ্যাত বেল ল্যাবরেটরিতে ট্রানজিস্টার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা কাজ করতেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনলজিতে আসেন। সে বছরই পাওলো অল্টোর (palo alto) পাশে,  “শোকলে সেমি কন্ডাকটর ইন্সটিটিউট” স্থাপিত করেন এবং ক্যামেরা ও অনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি বানাতে শুরু করেন।

সেমি কনডাক্টর তৈরিতে যেহেতু সিলিকন প্রয়োজন পড়ে, শব্দটার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা এখানে ছিলো।পরবর্তী দশ বছরে আরও ছোট বড় ৪০টি কোম্পানি স্থাপিত হয় বে এরিয়া। মার্কিন সামরিক বাহিনীর আনুসাঙ্গিক যন্ত্রও তৈরি করা হচ্ছিলো এখানে। ১৯৭১ সালে সাংবাদিক ডি হোফলারের একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি এলাকাটি সিলিকন ভ্যালি নামে প্রসার লাভ করে।H

কেন সিলিকন ভ্যালি বিশেষ ও বিখ্যাত:

আমেরিকার ৩৭% স্টার্ট আপের জন্মই হয় সিলিকন ভ্যালিতে।প্রযুক্তি বাণিজ্যে বিনিয়োগ করাটা ছিল সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু চাহিদা ও দ্রুত উন্নতির কারণে এটিই এখন তরুণ উদ্যেক্তাদের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অনেকেই এখানে আসছেন নিজেদের ভাগ্য বদলাতে। নতুন কোন আইডিয়াকে পুঁজি করে বদলে দিতে পৃথিবীকে। শুধু মাত্র উদ্ভাবনী আইডিয়া থাকলে, বিনিয়োগকারীরও অভাব হয় না এখানে। প্রযুক্তি জগতের কয়েক হাজার আইডিয়ার সফল শুরু ও বাস্তবায়ন ঘটেছে সিলিকন ভ্যালিতে। যা না হলে আজকের এই পৃথিবী সম্ভব হতো না।

সিলিকন ভ্যালি সম্পর্কে মজার কিছু তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো:

. দ্যা ভ্যালি অব হার্টস ডিলাইট (THE VALLEY OF HEART’S DELIGHT):

শুধু প্রযুক্তির শহর হিসেবেই নয়। চমৎকার আবহাওয়া, উর্বর কৃষি জমি, ও নান্দনিক পরিবেশের জন্য স্থানীয়রা অনেক আগ থেকেই শহরটিকে ডাকতো, দ্যা ভ্যালি অব হার্ট’স ডিলাইট নামে। ভ্রমণ পিপাসুরা চাইলেই এখানের চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দয উপভোগ করতে পারেন।

. ইনকিউবিটর বা পরিচর্যা কেন্দ্র:

ট্রানজিস্টার, কম্পিউটার, স্মার্টফোন কিংবা রোবটিক্স এর মতো উন্নত সব প্রযুক্তির উদ্ভাবন কিন্তু সিলিকন ভ্যালিতে হয়নি। তবে প্রযুক্তিবিদরা বিশ্বাস করেন, এসব পণ্যের পরিচযা ও সফল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এর সিলিকন ভ্যালির অবদান অন্যন্য।  তাই সিলিকন ভ্যালিকে প্রযুক্তির ইনকিউবেটরও বলা হয়ে থাকে।

. শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়:

সানফ্রান্সিসকো থেকে সানজোন্স পযন্ত বিস্তৃত এলাকাটিকে, কুপারটিনো, লস গাওস, মাউন্টেন ভিউ, সান জোস, সান ভ্যালি, সান্তাক্লারা, সান্তাক্লুজ নামে ছোট ছোট ত্রিশ(৩০) টি উপশহর ভাগ করা হয়েছে। এছাড়া প্রধান দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্টানফোর্ড, হার্ভাড ছাড়াও সানজোস, সান্তা ক্লারা, কারেনিজ মেলন ও নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি রয়েছে এখানে। অনেকে অবাক হলেও সত্য, স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোন বার বা পানশালা নেই।

. লাখপতিদের শহরে:

ক্যালফোর্নিয়ায় অবস্থিত সিলিকন ভ্যালিতে আমেরিকার মিলিনিয়রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রযুক্তিবিদদের ক্যারিয়ারে সফলতা পেলে অর্থ উপার্জনে সময় লাগে না।আমেরিকার অন্য যেকোন শহরের চাইতে সানফ্রান্সিসকো বে তে মিলেনিয়রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে বিপরীত চিত্রও কম নয় এখানে। অনেক নতুন কর্মীরা সামর্থ্য হচ্ছে না, তাই ভ্যান গাড়িতে রাত পার করে।

. অফিস যখন বসত বাড়ি:

সিলিকন ভ্যালি কোটিপতিদের শহর। তবে চাকরি করতে আসা নতুনদের এখানে সংগ্রাম করতে হয়। আয় আর ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে মেধাবী নতুন তরুণরা বেছে নিচ্ছেন বিকল্প পথ। বাড়ি ভাড়ার ব্যয় লাঘবে তারা গাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা করছেন।

সবচেয়ে আধুনিক ও অভিজাত কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের সুযোগ, সুবিধা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন। গুগল ফেসবুকের মত বড় বড় কোম্পানিরা, থাকা- খাওয়া, বিশ্রাম, খেলাধুলা সহ সবধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা দিয়ে থাকে তাদের প্রতিষ্ঠানের ভিতেরেই। সার্বিক নিরাপত্তায় কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের জন্য তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে থাকেন।

তাই নি:সন্দেহে, বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য জীবনের জন্য যেকোন স্বপ্নভুক তরুণের জন্য সিলিকন ভ্যালি ই হতে পারে স্বপ্ন জয়ের আদর্শ ঠিকানা।

তথ্যসূত্র: ডেইলি মেইল, সিএনএন, উইকিপিডিয়া।

Leave A Reply

Your email address will not be published.