‘তিমিদের সে কান্না ভোলার মতো নয়’
তীরে অগভীর পানিতে আটকা পড়েছিল তিমিগুলো। তারা কাঁদছিল এবং ছটফট করছিল মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের সহায়তা করার মতো কোনো উপায় ছিল না। ট্রাভেল ব্লগার লিজ কার্লসন আর তার বন্ধু জুলিয়ান রিপলের চোখে পড়ার পর তারা সেগুলোকে ঠেলেঠুলে আরও একটু গভীর পানিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অত বিশালাকায় প্রাণীর জন্য দু’জন মানুষের এই চেষ্টা ছিল সম্পূর্ণ বৃথা। ফলে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে অতিকায় প্রাণীগুলোর বোবা কান্নার সাক্ষী হয়ে থাকতে হয় লিজ কার্লসনকে। তিনি বলছেন, ওই সময়ের যে অভিজ্ঞতা, তিমিগুলোর কান্না— এগুলো কোনোভাবেই ভোলার মতো নয়।

মার্কিন ট্রাভেল ব্লগার লিজ কার্লসন তার সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে। সেখানেই তিনি বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের স্টুয়ার্ট দ্বীপে সমুদ্র তীরে আটকা পড়ে মারা যাওয়া ১৪৫টি পাইলট প্রজাতির তিমির চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করার ঘটনার কথা।
লিজ বলছেন, বন্ধু জুলিয়ান রিপলকে নিয়ে পাঁচ দিনের ভ্রমণে গিয়েছিলেন ওই দ্বীপে। ঠিক সূর্যাস্তের সময়ই তারা ওই এলাকায় হাঁটছিলেন। তারা দু’জন দূর থেকে লক্ষ্য করেন, সমুদ্র তীরের কাছাকাছি এলাকায় অনেকগুলো তিমি জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শেষ বিকেলের আলোয় ওই মুহূর্তে তিমিদের ছটফট করতে করতে মরে যাওয়ার মতো মর্মান্তিক দৃশ্য তাদের চোখে পড়বে, তা তারা কখনও ভাবতেও পারেননি।
লিজ বলেন, আমরা হতবাক হয়ে যাই। প্রথমে বুঝতেই পারি ওগুলো তিমি। এ ধরনের ঘটনার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।নিউজিল্যান্ডের মুল ভূখণ্ড থেকে দূরবর্তী সেই স্টুয়ার্ট দ্বীপে বসে তারা দু’জন শুধু ভাবছিলেন, আসন্ন মৃত্যু থেকে তিমিগুলোকে কিভাবে সাহায্য করা যায়। প্রায় জনমানবহীন দ্বীপে ১৫ কিলোমিটার দূরে কিছু সংরক্ষককর্মী ছাড়া অন্য কেউ পরিচিতি ছিল না তাদের। জুলিয়ান তাদের কাছে সহায়তার জন্য ছুটলেন।
লিজ জানান, বিস্তৃত সেই সমুদ্রতীরে তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব শক্তি দিয়ে শুধু একটি তিমি শাবককে কিছুটা সরানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু শাবকটি বারবার সমুদ্রতীরেই ভেসে আসতে থাকে। তাই শাবকটিকে কোলে নিয়ে বসে থাকা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।
ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে লিজ লিখেছেন, ‘চোখের দিকে তাকালে প্রাণিদের ভয় বুঝতে পারা যায়। ওরা মানুষের মতোই তাকায়। আমি জানতাম, ওরা সবাই মারা যাবে। আমি শুধু হতাশায় কাঁদছিলাম। একা ছিলাম আমি।’
কয়েক ঘণ্টা পর কয়েকজন রেঞ্জারকে নিয়ে ফিরে আসেন লিজের বন্ধু জুলিয়ান। তবে রাতের জোয়ারের সময় তারা সবাই মিলে চেষ্টা করেও তিমিগুলোকে গভীর সমুদ্রে ঠেলে দিতে সক্ষম হননি। পরদিন সকালে তারা আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে পান। তখন ভাটার টানে সমুদ্রতীরে আটকা পড়ে আছে তিমিগুলো। অনেক তিমিই মারা গেছে ততক্ষণে। সূর্যের তাপে তিমিরা তীব্র যন্ত্রণা পোহাচ্ছিল, তা ওদের চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল।
লিজ বলেন, ওদের চোখে পানি ছিল, ওরা কান্নার মতো শব্দ করছিল। আমরা বুঝতে পারলাম, একটি তিমিকেও আমরা বাঁচাতে পারব না। তাই রেঞ্জাররা তিমিগুলোকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। নতুবা ধীরে ধীরে কষ্ট পেয়ে তিমিগুলো মারা যেতে।
লিজ বলছেন, এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বাজে রাত।

নিউজিল্যান্ডের ডিপার্টমেন্ট অব কনজারভেটিভ জানিয়েছে, মৃত তিমিগুলো তারা সরাতে চেষ্টা করবে না। প্রকৃতির নিয়মে যা হওয়ার, তাই হবে এখানে।
নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রতীরগুলোতে তিমি প্রায়ই ভেসে আসে। তবে এতগুলো তিমির একসঙ্গে ভেসে আসা ও মৃত্যু বিরল ও হৃদয়বিদারক। ডলফিন বা তিমি কেন সমুদ্র তীরে এভাবে আটকা পড়ে, তা এখনও গবেষকরা জানতে পারেননি। তবে ধারণা করা হয়, অসুস্থতা, চলার পথে দিক ভুল করা, জোয়ারে ভেসে অথবা সমুদ্রে অপেক্ষাকৃত বড় কোন সমগোত্রীয় বা ভিন্ন প্রাণির হামলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
আরও একটি ধারণা রয়েছে, পাইলট তিমিরা দলবদ্ধ ও সামাজিক। কোনো একটি তিমি পথ হারালে তাকে অন্য তিমিরা সাহায্য করতে ছুটে আসে। আর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তখন তারা সবাই মিলে আটকা পড়ে যায়। স্টুয়ার্ট দ্বীপের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করছে কনজারভেটিভ ডিপার্টমেন্ট।
লেখাটি পূর্বে সারাবাংলায় প্রকাশিত