গল্প: শহুরে অন্ধকার

0 723

ভোরের আকাশে শুকতারা। চাঁদের আলো তার মায়াময় শোভা ছড়াচ্ছিলো পুরো শহরটা জুড়ে। পৃথিবীর এ এক কোণে ; এ এক অদ্ভ’ত সময়। ব্যস্ততার লেশ মাত্র থাকছে না এখানে কোথাও ; কেবল শুধু প্রাণহীন নীরবতা। রাস্তাঘাট আর সমস্ত গৃহকোণ।

তবুও কেউ জেগে থাকে। এ এক অন্য জীবন। শহরের মাঝেই ছোট্ট একটি পার্ক। পার্কের দু ধার ছড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে এলোমেলো কয়েকটি প্রশস্ত রাস্তা। সে রাস্তার দু পাশে সারি সারি জারুল কাঠগোলাপ, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার অপূর্ব সমাহার। পার্কে রয়েছে কয়েক‘শ প্রজাতির ফুল। অদ্ভ’ত সুগন্ধ ছড়ায় সেখানে। রাত যত বাড়ে,বাড়ে তত নিয়ন আলোর উজ্জল ততটা। লেকের স্বচ্ছ আলোয় সেসব প্রতিবিম্ব কেমন ভূতুড়ে লাগে।

জয়িতা দেখতে থাকে আকাশটা। আর আকাশের ওই বড় চাঁদটা।

পাশেই বিমানবন্দর। পিছনের দিকটায় লেক আর ওপাশে বস্তি। সেখানেই থাকে জয়িতা। আর এ পার্ক। এখানেই তার জীবন। আয় রোজগার সব। সারাদিন ভর চলে এখানে পাঁচমিশালী মানুষের আড্ডাখানা। জয়িতা চা বিক্রি করে, পান বিক্রি করে। সাথে থাকে তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। তবে সন্ধ্যে হলেই সব চুপসে যায়। তখন জয়িতা বাসায় গিয়ে রান্নার আয়োজন করে। সন্তানদের অ আ শিখায়। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আবার চলে আসে পার্কে। প্রায় রাতেই একা একা সময় কাটাতে হয় তার। যখন সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়, বাঁশির শব্দ শুনতে পায় দূর হতে। কেউ তাকে ডাকে না। হয়তো ডাকে।  সে শুধু মাতাল হয়। ওহ! এটা তো ট্রেনের হুইসেল।

তার সাথের কেউই নেই আর সবাই বাসায় চলে গেছে তবু আরো ঘন্টাখানেক এখানে থাকবে বলে ঠিক করলো সে। যদি আরো দু একজনকে পাওয়া যায় মন্দ হবে না। আর পাঁচশ টাকা হাতে আসলে, ছেলে শুভ‘র প্রাইভেট মাস্টারের টাকাটা দিয়ে দেয়া যাবে কালই। বাড়ি ভাড়াটা যদি বলে কয়ে আর কদিন পেছানো যায়। মুদি দোকানেও বাকি পড়ে আছে কিছু টাকা। জয়িতার চিন্তা হচ্ছিলো ছোট মেয়ে তানিয়ার জন্য। মেয়েটার গত দুদিন ধরে হলো জ্বর। অবস্থা আরো খারাপ দেখলে কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তাই হাতে কিছু টাকা রাখা!

বড় বড় নি:শ্বাস ছাড়ছিলো ও আর একটু পর পর হাঁটছিলো যাতে ঘুমিয়ে পড়তে না হয়। জয়িতা তখন যা ভাবছিলো তাই হলো। গেট প্রহরী আসলো আরো কিছু পর। বেটপ মোটা ও খাটাশের মত দেখতে লোকটা কখনো টাকা চায় কখনো শরীর চায়। আজ কোনটা নিতে এলো বোঝা মুশকিল।

না,লোকটা খুবই শান্ত ব্যবহার করেছে আজ।

জয়িতা ভাবছিলো তার ছোটবেলার কথা। স্বামী সংসার ছাড়া এই ছন্নছাড়া জীবন। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে অস্বিত্বের লড়াই আর টিকে থাকাই জীবনের কথা। বাকি সবই ভ্রান্তি আর মিথ্যা। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ছিলো জয়িতা। শেষ রাতে মাথার উপর দিয়ে কর্কশ শব্দে উড়ে গেল পরপর দুটি বিমান। সে বিমানের শব্দ ফুরাতে না ফুরাতে পিছন থেকে কয়েকটা বখাটের রুঢ় স্বর তার কানে লাগলো।

আজ ভ্যাপসা গরম পড়েছে চারদিকে। জয়িতার শরীরটা ঘামছিলো। সে বড় টাকার নোট দুটি শাড়ির আঁচলে শক্ত করে বাঁধলো। মাথার এলোমেলো চুলগুলি ঠিক করে নিলো। আঁচল থেকে মোবাইলটা খুলে নিয়ে তাতে দেখলো রাত সাড়ে এগারোটা বাজে এখন। আর থেকে কাজ নেই। বড় বড় পা ফেলে কয়েকটা পুল পেরুলো ও। মিনিট পনেরর মধ্যে বড় বড় কয়েকটি গলি পেরিয়ে সে পৌঁছে গেল টিনশেড ছাওয়া বস্তিতে। সামনের কয়েকটা দোকানে আলো জ্বলছিলো তখনো। বুড়ো মুদি দোকানদার চাচা তার দোকান খোলা রেখেছিলেন। জয়িতা পাঁচ কেজি চাল, আলু,পেয়াঁজ,রসুন টুকিটাকি আরো কিছু কিনলো। এক হালি ডিম,পাউরুটি,কলা ও বিস্কিট কিনলো অসুস্থ মেয়েটির জন্য। দোকানি সব সদাই বড় একটা পুঁটলিতে ভরতে ভরতে জানতে চাইলেন, “মাইয়্যার জ্বর কমছে?”

জয়িতা বললো, “না।”

“ডাক্তারের কাছে নেছ নাই এহনও? দেরি করিস না কইলাম। পরে বড় হইয়া গেলে ঝামেলা টের পাইবি? টেকা পয়ঁসার আছে না লাগবো?”

“টাকা আছে। চাচা আপনে তো আগের এক হাজার পাবেন। এগুলার দাম আর পাঁচশ রাখেন।”

“আজকা ভালাই কামাইছস?”

জয়িতা কিছু বললো না। আঁচলের মুঠি থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে দিলো দোকানদারকে বুড়োকে। হাতে সদাই নিয়ে ঘরে চললো জয়িতা।

কিছুদূর যেতেই,পেছন থেকে ডাকলো সে বুড়ো।

এতবড় একটা ব্যাগ পিছনে আবার বয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো জয়িতার। দোকানদারটি তখন জয়িতার দিকে উতসুক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। জয়িতার কাছে এলে বার কয়েক তিনি বাতির এ ফোঁড় ও ফোঁড় উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলেন নোটটি। এ হাত ও হাতের মুষ্ঠিতে নিয়ে চাপ দিয়ে দেখলেন আর দু পাশের ছবি আর ফুলটা মিলালেন বার কয়েক। হুম,যা সন্দেহ করছিলেন তাই তো। নিশ্চিত না হয়ে কিভাবে পারেন!

“কই পাইল এই টেকা?”

জয়িতা কিছু বুঝতে না পেরে উত্তর দিলো, “ক্যান?”

“আরো আছে?”

“ক্যান? কি হইছে?”

বুড়ো প্রায় বিরক্ত হলেন।

“আরে মাইয়্যা দেহা দেহি।”

জয়িতা অনিচ্ছ সত্ত্বেও আঁচলের গিঁট খুলে আরো একটি এক হাজার টাকার নোট বুড়োর হাতে রাখলো। বুড়ো আবিস্কার করতে পেরেছেন ভেবেই তৃপ্তি! যেমনটি আমেরিকা জয়ের পর কলম্বাসের হয়েছিলো হয়তো।

“তোরে তো ঠক দিছে। জাল টেকা।”

কথাটা জয়িতার কান ফুঁড়ে ঠুকলো না ঠিক করে।

“কি কন চাচা?”

“কার কাছ থেইকা নিছছ? কাস্টমার চিনস?”

জয়িতার চোখ ভেঙ্গে কান্না এসে গেল! এ কি শুনছে সে?

ঘরটা বড্ড ছোট। ছোট একটি টেবিল ছাড়া,কোন আসবাপত্র নেই। জয়িতার চোখে ঘুম ঘুম তবে ঘুম ছিলো না কোন। সারা রাত জ্বরে কাতর মেয়েটা কাতরাতে কাতরাতে এই বুঝি একটু ঘুমোলো। পানির পট্টিটা মেয়ের কপাল থেকে হালকা করে তুলে নিলো জয়িতা। পাশে রাখা মোমের আলো ফুঁ দিয়ে নেভালো। অন্ধকারেই শেষবারের মতন টেবিলের উপর পানির গ্লাসের নিচে চেপে রাখা কাগজের নোট দুটিতে চোখ গেল তার। বড্ড অস্বস্তি আর ঘৃণা তার চোখেমুখে। মানুষ ও আবার এমন হয়।  প্রশ্নটা নিজেকে করে জয়িতা কপাল কুঁচকালো! এ প্রশ্ন করা তাকে তো মানায় না। জীবনের কত রুপই তো তার চেনা আছে!

ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে তখন ভোঁস ভোঁস করে শ্বাস ছাড়ছিলেন আর ঘুমোচ্ছিলেন স্বপ্নারাণী। মহিলারাও এমন বিশ্রী নাক ডাকতে পারে? জয়িতা ভাবলো। আরো একবার ভাবলো কাল ভোর হলে আরো কয়েকটা দোকান দেখা যাবে। বুড়া লোকটা কি না কি বলেছে। আসলে আমাদের সমাজটা যাচ্ছে কোথায়? মানুষ কি আর মানুষ থাকছে না?  দেহ বেঁচার টাকাটাও কি মানুষ ঠকিয়ে নকল দিতে হবে? কে কার কাছে বিচার চাইবে?

সকাল হলো।

জয়িতা’র মুখ বিষণ্ন। মেয়েটার জ্বর বেড়েছে। ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কিন্তু ফ্যাকড়া বাঁধলো ফার্মেসীতে গিয়ে। টাকাটা ফিরিয়ে দিলো ওরা। ওষুধ দিলো না। জয়িতার মাথায় জিদ চাপলো। একি কথা!

বাচ্চা মেয়েটা যে বিকালে মারা গেল।

সে রাতে আবার বেরুলো জয়িতা। রাত বাড়ছে ট্রেনের হুইসেল শুনছে সে আর দেখছে আকাশের বড় চাঁদ। এ শহরের বেশিরভাগই লোকই খারাপ। জীবন জীবিকা ও বেঁচে থাকার তাগিদে তারা অন্যের ক্ষতি করে। আর বাকি লোকগুলো আরো বেশি খারাপ। এরা জীবনের পথ খুঁজে পায় না। হেঁয়ালির বসে সবার ক্ষতি। এতদিন ওরা পতিতাদের কাছ থেকে চাঁদাবজি করেছে? ব্লাউজের তলায় হাত দিয়ে খোপ করে রাক্ষসের মতন অন্যের পরিশ্রমের টাকা নিয়ে গেছে? আর এখন বেশ্যাদের নকল টাকা দিয়ে মজা লুটতে আসছে? কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না,এরা সবাই শহরের বড় ঘরের ছেলেপেলে। অর্থ ঐশ্বয্য যাদের জীবনটা অসময়ে ভুল পথে নিয়েছে। এখন না পেরেছে নিজের পরিবারকে আপণ করতে না পেরেছে বাহিরের জগতটাকে বুঝতে। এরা সব জায়গায় নিজের আধিপত্য দেখতে চায়। জয়িতা এতদিন কিছু বলেনি কাউকে। শুধু এড়িয়ে চলেছিলো এ পশুদের। আজ সময় হয়েছে। ও শুধু অপেক্ষা করছিলো।

মদ খেয়েছ এসেছিলো ওরা।

মতলামি গলায় ওদের একজন চেঁচাতে থাকে, “আজ কত কামালি রেন্ডি শালী? দেহা তো?”

জয়িতা ভয়ে ঝোপের আড়া লুকালো। লুকালো নিয়ন আলো ছাড়িয়ে একটু আঁধারে। সে ভয় পাচ্ছে।

“ভয় পাইছে। ভয় পাইছে।” অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সাথে থাকা অন্যরা।

ওরা গতকালের নকল টাকা কথা তুলেও জয়িতার সাথে হাসি ঠাট্টা করতে থাকে।

তখন জয়িতা কাঁপছিলো। একটু পর কি হবে তাই ভেবে কাঁপছিলো। ঝোপে লুকিয়ে রাখা ধারালো অস্ত্রটা বের করে সাঁ সাঁ করে চারটা দেহ আলাদা করে ফেলে সে শরীর থেকে। এরপর লাশগুলো টেনে রেললাইনে ফেলে আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। তখনও ট্রেনের হুইসাল বাঁজছিলো!

Leave A Reply

Your email address will not be published.